ওষুধের ইতিহাস
হিপোক্রাটিস্
ওষুধ বিজ্ঞানের ইতিহাসে ইউরোপের বিশেষ করে গ্রিস ও রোমের চিকিৎসকদের অবদান সুবিদিত। তাঁদের মধ্যে হিপোক্রাটিস্, ডিওসকোরাইডিস্, গ্যালেন প্রমুখ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। হিপোক্রাটিস এতোই বিখ্যাত যে তাঁকে ইউরোপ মহাদেশের বিজ্ঞানীরা ‘ফাদার অব্ মেডিসিন’ নামে অভিহিত করেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪২৫ সালে গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লিখিত বইয়ের নাম ‘ম্যাটেরিয়া মেডিকা’ যা তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়ানো হতো। বইটিতে অসংখ্য গাছগাছড়াজাত ওষুধ, সেগুলো তৈরির প্রক্রিয়া, সেবনবিধি ও মাত্রা ইত্যাদি রয়েছে। তিনি চিকিৎসকদের নৈতিকতার ওপর খুব জোর দিতেন। যে কারণে নবীন চিকিৎসকদের পেশায় প্রবেশকালে নৈতিকতার শপথ নেয়ার জন্য ‘হিপোক্রাটিক ওথ’ রচনা করেন, যা আজো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসরণ করা হয়।
হিপোক্রাটিস্
ডিওসকোরাইডিস
ডিওসকোরাইডিস্ ৩০ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে রোমে চলে যান এবং কালক্রমে সেখানে বিখ্যাত সম্রাট নিরোর প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হন। সম্রাট ও সেনাবাহিনীর সাথে তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের চাইতে সেই সব দেশের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে তথ্য বিনিময়ে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন দেশের সহস্রাধিক গাছগাছড়ার ছবি এঁেক এগুলোর ওষুধি গুণাগুণের কথা লিপিবদ্ধ করে ‘দ্য মেটেরিয়া মেডিকা’ নামে বই লিখে গেছেন। পরবর্তীকালে তাঁর এই গ্রন্থ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে অনেকগুলো ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর দেড় হাজার বছর পরেও এই বইটি মেডিকেল ছাত্রদের পাঠ্য ছিল।
ডিওসকোরাইডিস
গ্যালেন
রোমের আরেকজন অত্যন্ত বিখ্যাত চিকিৎসক গ্যালেন ১৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তিনি ছিলেন প্রথম ফার্মাসিস্ট, কারণ তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধসামগ্রী প্রস্তুত ও বিক্রি করতেন। তিনি মলমকে উন্নত করেন, ইমালশান আবিস্কার করেন এবং পরবর্তীতে এখান থেকে সর্বপ্রথম কোল্ড ক্রীম তৈরি করেন। তাঁর লেখা, চিন্তাধারা ও চিকিৎসা পদ্ধতি প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চিকিৎসা শাস্ত্রকে প্রভাবিত করছে। তিনি ছিলেন হিপোক্রাটিসের চিন্তাধারার সমর্থক। তিনি বিশেষ করে শারীরবিদ্যার বিভিন্ন অজানা দিক উন্মোচন করেন। সে সময় রোমে শব ব্যবচ্ছেদ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু গ্যালেন থেমে যাননি। তিনি বানর ও শুকরের দেহ ব্যবচ্ছেদ করেন এবং ধারণা করেন যে এদের সাথে মানবদেহের অনেক মিল রয়েছে। গ্যালেন স্নায়ুতন্ত্রের উপর বহু পরীক্ষা করে তত্ত¡ প্রদান করেন যে, ‘মস্তিষ্ক সব মাংসপেশীর কর্মকাÐ নিয়ন্ত্রণ করে’।
গ্যালেন
আল রাজী
অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় আরব চিকিৎসকদের ইতিহাস অত্যন্ত নবীন। মাত্র প্রায় ১,০০০ বছর পূর্বে এই চিকিৎসকরা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তাঁদের অসামান্য জ্ঞান-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। এঁদের মধ্যে আল রাজী, ইবনে সিনা প্রমুখ ছিলেন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। আল রাজী চিকিৎসার মূল ভিত্তি হিসাবে রসায়নকে গ্রহণ করেন। তখন রসায়নকে বলা হতো ‘আল-কেমি’। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের অত্যন্ত বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিনিই প্রথম চিকিৎসা ক্ষেত্রে গাছগাছড়ার বদলে মূল উপাদান বা পিওর কেমিক্যাল ব্যবহার শুরু করেন। ইউরোপের বিজ্ঞানীরা আল রাজীকে ‘র্যাজেস্’ নামে ডাকে। তিনি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত বিখ্যাত মুক্তাদারি হাসপাতালের প্রধান। তিনিই প্রথম গুটি বসন্ত ও হামের চিকিৎসা শুরু করেন। ফুলের পরাগ রেণু থেকেও যে এলার্জি হতে পারে তা তিনিই প্রমাণ করেন। এছাড়া তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন যে, শরীরে রোগ বিকাশের সাধারণ প্রথম ধাপ হলো জ্বর। ‘কিতাব আল মনসুরি’, ‘আল-হাউয়ি’, ‘মানলা ইয়াহ্দুরু আল-তাবীব’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
আল রাজী
ইবনে সিনা
ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ওষুধকে আধুনিক ও আকর্ষণীয় করার নিয়মের প্রবক্তা। তিনি তিক্ত ও বিস্বাদ ওষুধকে সুমিষ্ট, সুস্বাদু ও সুগন্ধময় করার উপায় হিসাবে সিরাপ আবিষ্কার করেন। বটিকাকে চিনির প্রলেপ দিয়ে ‘সুগার কোটেড’ করেন। হাতের বদলে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বটিকা তৈরির জন্য কাঠের ছাঁচ তৈরি করেন, পরবর্তীতে যার অনুকরণে ট্যাবলেট মেশিন আবিষ্কৃত হয়। তিনি ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এতটাই উন্নত করেন যে তাঁকে ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রধান বিজ্ঞানী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন’ সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই বইটি থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি গ্রিক ও আরব বিজ্ঞানীবৃন্দ এবং ভারতের চরক ও শুশ্রæত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এদের ভাল দিকগুলো গ্রহণ করেছিলেন। ইবনে সিনা অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ফার্মাকোলজীতে তাঁর অসামান্য অবদানের কারণে। তিনিই প্রথম সংক্রামক রোগ এবং যৌন রোগের ধারণা দেন। তিনি রোগের শ্রেণিবিন্যাস করেন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন করেন। স্বাস্থ্যবিধির আওতায় রোগ সংক্রমণকালে রোগীকে পৃথকভাবে রাখার ব্যবস্থারও প্রবর্তক তিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে রাজ-রোষের শিকার হয়ে ইবনে সিনাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়।
ইবনে সিনা